ভাসানচর হাতিয়ার নাকি সন্দ্বীপের, কেন এই দ্বীপ নিয়ে বিরোধ

শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫ সময়: ১৬:২১:৩২
বিজ্ঞাপন
This is curout pro

This is curout pro

মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ‘ভাসানচর’ দ্বীপের নাম মানুষ জানতে পারে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সরকারি সিদ্ধান্তের পর। তবে সম্প্রতি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপবাসীর বিরোধের কারণে আবারও আলোচনায় এসেছে ভাসানচর। সন্দ্বীপবাসীর দাবি, দ্বীপটি ওই উপজেলার অংশ। অপর দিকে হাতিয়াবাসী দাবি করছে, দ্বীপ জেগে ওঠার পর থেকে বনায়ন থেকে শুরু করে দ্বীপের উন্নয়ন নোয়াখালী থেকেই হয়েছে। সে কারণে দ্বীপটি প্রশাসনিকভাবে নোয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত।

সন্দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলের কাছাকাছি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভাসানচর জেগে উঠতে শুরু করে বলে বন বিভাগের তথ্য সূত্রে জানা গেছে। এরপর কয়েক দশক দ্বীপের ভূমির পরিমাণ বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালের দিকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের আলোচনার মধ্যেই সেটির নামকরণ হয় ভাসানচর। একই বছর দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে সেটিকে নোয়াখালীর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সেখানে ‘ভাসানচর থানা’ গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই প্রজ্ঞাপনেও ভাসানচরকে হাতিয়া ও নোয়াখালীর অংশ বলে উল্লেখ করা হলে সন্দ্বীপের ছাত্র, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ তখন বিক্ষোভ করেন।

সম্প্রতি সন্দ্বীপের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সীমানা জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে। ‘চট্টগ্রাম-নোয়াখালী জেলার সীমানা জটিলতা নিরসন কমিটি’ নামের এই কমিটিতে সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তার পাশাপাশি পেশাজীবীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভায় সিদ্ধান্তের আলোকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্গত দেখিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।

ভাসানচরের সীমানা বিরোধ নিরসনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই এ নিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মানুষজন নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। ৭ এপ্রিল এ নিয়ে নাগরিক কমিটির নেতা আবদুল হান্নান মাসউদ ফেসবুকে ভাসানচরকে হাতিয়ার দাবি করে একটি পোস্ট দেন। গত বুধবার ভাসানচরকে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে হাতিয়া দ্বীপ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করা হয়। একই দিন চট্টগ্রামেও হাতিয়াবাসীর পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হয়।

যা বলছে নোয়াখালী বন বিভাগ

ভাসানচরে প্রথম বনায়ন শুরু করে নোয়াখালী বন বিভাগ। নথিপত্র অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে জালিয়ারচরে বনায়ন শুরু করে নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগ। প্রথম দিকে চরের আয়তন ছিল কম। পরে ধীরে ধীরে দ্বীপের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বনায়নের আয়তনও। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দ্বীপটিতে বন বিভাগের বনায়নের পরিমাণ ৬ হাজার ৫২০ হেক্টর।

বন বিভাগের নথি অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের দিকে জেগে ওঠা এই দ্বীপের নাম ছিল জালিয়ারচর। ১৯৯৮ সাল থেকে সেখানে সরকারিভাবে বনায়নও শুরু হয়। হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে জালিয়ারচরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। চরের অবস্থান হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের সময় দ্বীপের নাম বদলে রাখা হয় ভাসানচর।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর উপলক্ষে ভূমি উন্নয়ন, বাঁধ ও ভবন নির্মাণের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে। ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর ভাসানচরে প্রথমবারের মতো পা রাখে রোহিঙ্গারা। এ পর্যন্ত ২২ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে ৩২ হাজার রোহিঙ্গাকে।

হাতিয়া উপজেলার চর ঈশ্বর ইউনিয়নের জালিয়ারচর থেকে ভাসানচরে রূপ পাওয়া এই চরে বিগত বছরগুলোতে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছিল নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে। কিন্তু সম্প্রতি জোনাল সেটেলমেন্ট কার্যালয়, চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে পাঠানো একটি চিঠি ভাসানচরকে সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত মর্মে মত দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে নানা সমালোচনা শুরু হয়।

নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউছুফ প্রথম আলোকে বলেন, ভাসানচর নোয়াখালীর মেঘনায় জেগে ওঠা একটি চর। নব্বই সালের দিকে কিংবা তারও আগে চরটি জেগে উঠতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালের দিকে সেখানে নোয়াখালী বন বিভাগ থেকে বনায়ন শুরু হয়। বছর বছর বনায়ন বাড়তে থাকে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সেখানে ৬ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে বনায়ন করে জেলা বন বিভাগ।

সন্দ্বীপের ন্যায়ামস্তি ইউনিয়ন ও ভাসানচর

ন্যায়ামস্তি নামের সন্দ্বীপের একটি ইউনিয়ন পুরোপুরি সাগরে বিলীন হয়ে যায় ১৯৯২ সালে। এরপর ওই স্থানেই নতুন ভূমি জেগে ওঠে। সন্দ্বীপ থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে জেগে ওঠা নতুন দ্বীপটিই ভাসানচর। সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের দাবি, এটি ভাঙনে বিলীন হওয়া ন্যায়ামস্তি ইউনিয়নের জায়গায় গড়ে উঠেছে। সে কারণে দ্বীপটি সন্দ্বীপের।

সন্দ্বীপের প্রায় সব ইউনিয়নের বাসিন্দাদের আদি ভিটা ছিল ন্যায়ামস্তিতে। ফলে ভাসানচর নোয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত করার সরকারি ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন সন্দ্বীপের মানুষ। সে সময় মনিরুল হুদা নামের সন্দ্বীপের এক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত নির্বাহী বিভাগের প্রতি জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও প্রতিপালিত হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নির্বাহী বিভাগ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সরকারি কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে।

কমিটিতে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসকসহ সন্দ্বীপ ও হাতিয়া উপজেলা থেকে তিনজন করে পেশাজীবীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গত ৯ মার্চ এই কমিটির প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সিএস ও আরএস জরিপ এবং স্যাটেলাইট ইমেজ পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগ ভাসানচরকে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার ভূমি বলে প্রতিবেদন জমা দেয়।

ভূমিহীনদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে যা জানা যাচ্ছে

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নতুন জেগে ওঠা চর বা দ্বীপ বসবাস উপযোগী হওয়ার পর সেটি প্রথম ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ওই দ্বীপে জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিহীনেরা অগ্রাধিকার পান। তবে এখনো এ বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। তা ছাড়া এই দ্বীপে রোহিঙ্গা শরণার্থী থাকায় সেখানে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা যাবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।

এ ব্যাপারে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইশতিয়াক আহমেদ ও সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, হাতিয়া ও সন্দ্বীপ দুটিই ভাঙন কবলিত এলাকা। তবে সেখানে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের বিষয়ে বহু পাক্ষিক পর্যালোচনার প্রয়োজন হতে পারে।

কমিটির বৈঠকে এনসিপির দুই নেতা

গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ভাসানচরের সীমানা জটিলতা নিরসনে এই লক্ষ্যে গঠিত কমিটির ১৮ জন সদস্যকে নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কমিটির সদস্য না হয়েও জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ অংশ নেন। এ সময় সভাকক্ষে মাসউদের উপস্থিতিতে আপত্তি জানায় সম্মেলনকক্ষের বাইরে জড়ো হওয়া সন্দ্বীপের বাসিন্দারা। তবে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) নূরুল্লাহ নূরী বলেন, ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে হাতিয়ার পক্ষে হান্নান মাসউদ ও সন্দ্বীপের পক্ষে নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য এহসানুল মাহবুবকেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে ভারসাম্য রক্ষা হয়েছে।

সভায় চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর পক্ষে সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ভৌগোলিক মানচিত্র, সিএস, আরএস জরিপের মৌজা নকশা পুনরায় বিশ্লেষণ করা হয়।

সভায় ২০১৭ সালের দিয়ারা জরিপে কিসের ভিত্তিতে ভাসানচরকে নোয়াখালীর অন্তর্গত দেখানো হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুনরায় সভা করে কমিটির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নূরুল্লাহ নূরী।


0%
0%
No Comment Yet